ঢাকা ১১:৫২ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জৈব রসায়নবিদ থেকে প্রেসিডেন্ট

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:২২:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ জুন ২০১৫
  • ৩৫৮ বার

আমিনা গারিব-ফাকিম। মরিসাসের ডাকসাইটে জীবন-বিজ্ঞানী। জীববৈচিত্র্য ও জৈব রসায়নের এই সফল সাধক মরিসাসের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। কাকতালীয় কি না বলা মুশকিল, ‘পরিবেশবান্ধব’ এই সাধক প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিচ্ছেন ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে!

আকাশ নীল হয়, গাছেরা সবুজ। কখনো কখনো গাছও রঙ বদলায়।

কেন?

ছোট্ট আমিনার মনের কোণে কৌতূহল-তরঙ্গে যেসব জিজ্ঞাসা খেলে যেত, এই প্রশ্নটা ছিল তার অন্যতম।

স্কুলের মাস্টারমশাই যুতসই একখানা জবাব দিয়েছিলেন বটে। কিন্তু জীবন ও জগতের রহস্যঘেরা অনেক বিষয়ই রোমাঞ্চিত করত আমিনাকে। তাই প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করা তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।

শিক্ষাগুরুরা আমিনাকে শিখিয়েছিলেন, রান্না থেকে কাপড় ধোয়া—প্রতিদিনের জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর দেয় বিজ্ঞান। আর এভাবেই পুরোদস্তুর এক প্রশ্নবালিকা বনে গিয়েছিলেন কিশোরী আমিনা। বলা বাহুল্য, প্রশ্ন করার অভ্যাসই একদিন তাকে স্বদেশভূমি থেকে ইংরেজদের দেশে ‘নির্বাসিত’ করেছিল। সেই স্বেচ্ছা নির্বাসন ছিল জ্ঞানের জন্য, জীবনসংসারের গূঢ় রহস্য উন্মোচন করার জন্য।

উচ্চশিক্ষার বিষয় হিসেবে আমিনা বেছে নিয়েছিলেন রসায়নকে। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব সারে থেকে ১৯৮৩ সালে তিনি রসায়নে স্নাতক সম্পন্ন করেন। আর ১৯৮৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার থেকে জৈব রসায়নে পিএইচডি।

শৈশবের বিজ্ঞানবোধ

দ্বীপদেশ, কিংবা আমিনার ভাষায়, ‘জীববৈচিত্র্যের স্বর্গভূমি’ মরিসাস ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার আগেই জীবনের ব্রত স্থির করেছিলেন আমিনা।

তার শৈশবস্বপ্ন নিয়ে এক আলোচনায় ফ্রান্সের পিয়েরে এ্যান্ড মেরি কুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউপিএমসি) ভাইস প্রেসিডেন্ট (শিক্ষা) ফেব্রিক কেমলা বলেছেন, ‘১৯৭৮ সালে প্রথম টেস্টটিউব বেবি লুইস ব্রাউনের জন্ম হয়েছিল। সে সময় আমিনা (তখন তার বয়স উনিশ) উপলব্ধি করেছিলেন, ‘বিজ্ঞান সত্যি সত্যি জীবন বদলে দিতে পারে।’

উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর আমিনার এই উপলব্ধি বাস্তব একটা ভিত পেয়েছিল। তিনি অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দেশমাতৃকার উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নেন।

ইউপিএমসিকে দেওয়া এক সম্ভাষণে আমিনা গারিব-ফাকিম সেই ‘মধুর মুহূর্ত’ সম্পর্কে বলেছেন, ‘পিএইচডির পর যুক্তরাষ্ট্রে পোস্টডক করার সব হিসেবনিকেশ তৈরি ছিল। কিন্তু তার বদলে আমি মরিসাসে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিই।’

আমিনা বলেন, ‘সাংশ্লেষিক জৈব রসায়ন নিয়ে আমার যত গবেষণা যত প্রশিক্ষণ, সবকিছু সেখানে আমি সম্পূর্ণ নতুন এক জ্ঞানশাস্ত্রে প্রয়োগ করি। বলছি, ফাইটোকেমিস্ট্রির কথা।’

ফাইটোকেমিস্ট্রি হলো উদ্ভিদ ও উদ্ভিজ্জ উপাদান নিয়ে এক বিশেষ রসায়নশাস্ত্র। এখানে উদ্ভিদ থেকে তার প্রাকৃতিক উপাদানগুলো সংশ্লেষ করা হয়।

মরিসাসে প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে আমিনা বলেন, ‘আমার এই অভিবাসন খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কেননা বিশ্বের অন্যতম অসাধারণ জীববৈচিত্র্য হটস্পটে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমি খুব উর্বরই হব।’

বৈজ্ঞানিক ব্যবসায়িক

দেশে ফেরার পর সেই কথা প্রমাণ করেছেন আমিনা। ১৯৯৪ সালে তার নেতৃত্বেই মরিসাসে প্রথম সুগন্ধী ও ঔষধী উদ্ভিদের একটা তালিকা তৈরি হয়।

সে সময় মরিসাসে ৬৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ ছিল। এদের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ উদ্ভিদ ছিল স্থানীয় বা স্বদেশী। এই কাজটা সহজ ছিল না মোটেও। উদ্ভিদরাজি ও এদের গুণাগুণ উদ্ধার করতে স্থানীয়দের দরবারও করেছেন আমিনা। তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতেন। আর গবেষণাগারে সেসব তথ্য যাচাই করতেন। এভাবেই আমিনা আফ্রিকার ঔষধী উদ্ভিদকে পণ্যজাত দিলেন।

এ সম্পর্কে আমিনা বলেছেন, ‘আমি জানি, গবেষণা ও উন্নয়নের যুগপৎই একটা দেশের উন্নতির ইঞ্জিন। এ জন্য আমি আমার গবেষণা-জ্ঞানকে ব্যবসায়িক রূপ দিতে চেয়েছিলাম। এটা আমাকে একজন বৈজ্ঞানিক ব্যবসায়িক হিসেবে তৈরি করেছিল।’

তার গবেষণা আমিনাকে অন্তত ২০টি বই লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখেছেন আশিখানার মতো। তার সম্পাদনায় ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে আফ্রিকার প্রথম ফার্মাকোপিয়া।

স্বীকৃতি ও সম্মাননা

দেশী-বিদেশী বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বিজ্ঞানী আমিনা। ২০০৭ সালে এল’ওরিয়াল-ইউনেস্কো উইমেন অব ইন সায়েন্স নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৯ সালে আফ্রিকান ইউনিয়নের অন্যতম ‘উইমেন ইন সায়েন্স’ নির্বাচিত হন। একই বছর ‘নাইট অব দ্য অর্ডার অব এ্যাকাডেমিক পামস’ পদবীতে সম্মানিত হন আমিনা। ইউনিভার্সিটি অব পিয়েরে এ্যান্ড মেরি কুরি তাকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।

আমিনা ২০০৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অব মরিসাসের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

জীবনে এমন সফল হওয়ার গোপন কোনো রহস্য আছে নাকি কোনো? আমিনাকে জানতে চাইলে তিনি বলবেন, ‘নিজের সর্বোচ্চটা ঢেলে দাও। আর যা করছ তা আনন্দ নিয়ে করো।’

আনন্দের সঙ্গে কাজ করলে ক্লান্তি আসে না জীবনে। আমিনা যেমনটা বলেছেন, ‘তুমি যদি ভীষণ উচ্ছ্বাস-উৎসাহ নিয়ে কাজ করো, দেখবে জীবনে যেন একটা দিনও তুমি কোনো কাজই করোনি। যেমনটা মনে হয় আমারও!’

‘আরেকটা মক্কা’ যার প্যারিসে

ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্তিত ন্যাশনাল ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়ামকে নিজের ‘মক্কা’ মানেন আমিনা। তার ভাষায়, ‘আমি যতবারই প্যারিসে যাই, ততবারই সেখানে ঘুরতে যাই। এটা আমার কাছে যেন আরেক মক্কা’।

প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট

মরিসাসের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৫ জুন শপথ নিচ্ছেন আমিনা। তিনি দেশটির ৬ষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শুক্রবার অধিষ্ঠ হচ্ছেন।

মরিসাসের সংসদ বৃহস্পতিবার আমিনাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করে। দেশটির সরকারি ও বিরোধী দল উভয়ই তাকে এক বাক্যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিয়েছেন। এটাকে ‘ঐতিহাসিক পরিবর্তন’ হিসেবে দেখছে মরিসাসের রাজনীতিকরা।

প্রসঙ্গত, আমিনার জন্ম ১৯৫৯ সালের ১৭ অক্টোবর, মরিসাসের সুরিনামে।

একদিন বাংলাদেশেও…

শুধু মরিসাসে নয়, উন্নত অনেক দেশে ক্ষমতার প্রধান পদগুলোতে বিজ্ঞানীদের অধিষ্ঠ হতে দেখা যাচ্ছে । যেমন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ থেকে চিলির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেনমিচেল ব্যাচেলেট। জার্মানির প্রথম নারী চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মার্কেল ছিলেন কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রির গবেষক।

এরকম পদে বিজ্ঞানীরা অভিষিক্ত হলে দেশের কি কোনো বাড়তি সুবিধে হয়? জানতে চেয়েছিলাম বিজ্ঞানী বিধান চন্দ্র দাসের কাছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই। দেশের উন্নয়নে নীতি-নির্ধারণে বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ থাকাটা খুব জরুরি।’

বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা কি এই স্বপ্ন দেখতে পারেন যে, সর্বোচ্চ ক্ষমতায় একদিন দেশের বিজ্ঞানীরাও আসীন হবেন?

ড. বিধান বলেন, ‘দেখুন, বঙ্গবন্ধুর সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিজ্ঞানীদের কিন্তু বড় একটা প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে ড. কুদরত-ই-খুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোস অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী প্রমুখের কথা।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক বিধান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু তার জামাতা হিসেবে খুঁজে পেয়েছিলেন একজন বড় মাপের পরমাণু বিজ্ঞানীকে।’

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের পর কি চিত্রটা বদলে যায়নি, বিজ্ঞানীরা কি সেভাবে আর নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে বিশেষ ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছেন? প্রশ্ন করি বিজ্ঞানীকে।

প্রাণীবিজ্ঞানী বিধান বলেন, ‘এটা ঠিক যে হারটা কমেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে আমরা বিজ্ঞানী-প্রকৌশলী-স্থপতিদের ক্ষমতায় আসতে দেখেছি। যদিও মরিসাসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আজ (৫ জুন) যিনি শপথ নিচ্ছেন, সেই আমিনার মাপের বড় বিজ্ঞানী আমাদের দেশে কজনইবা আছেন।’

তবে ড. বিধানচন্দ্র দাস আশাবাদী, সময়ই ফের চিত্রটা বদলে দেবে। এই বিজ্ঞানী বলেন, ‘বিজ্ঞানীদের দরকার পড়বেই। দেশের কল্যাণেই একদিন রাষ্ট্রযন্ত্র বিজ্ঞানীদের উচ্চাসনে অধিষ্ঠ করবে।’

সময়ই তবে যা বলার বলুক।

তথ্যঋণ : ইউপিএমসি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জৈব রসায়নবিদ থেকে প্রেসিডেন্ট

আপডেট টাইম : ০৪:২২:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ জুন ২০১৫

আমিনা গারিব-ফাকিম। মরিসাসের ডাকসাইটে জীবন-বিজ্ঞানী। জীববৈচিত্র্য ও জৈব রসায়নের এই সফল সাধক মরিসাসের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। কাকতালীয় কি না বলা মুশকিল, ‘পরিবেশবান্ধব’ এই সাধক প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিচ্ছেন ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে!

আকাশ নীল হয়, গাছেরা সবুজ। কখনো কখনো গাছও রঙ বদলায়।

কেন?

ছোট্ট আমিনার মনের কোণে কৌতূহল-তরঙ্গে যেসব জিজ্ঞাসা খেলে যেত, এই প্রশ্নটা ছিল তার অন্যতম।

স্কুলের মাস্টারমশাই যুতসই একখানা জবাব দিয়েছিলেন বটে। কিন্তু জীবন ও জগতের রহস্যঘেরা অনেক বিষয়ই রোমাঞ্চিত করত আমিনাকে। তাই প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করা তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।

শিক্ষাগুরুরা আমিনাকে শিখিয়েছিলেন, রান্না থেকে কাপড় ধোয়া—প্রতিদিনের জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর দেয় বিজ্ঞান। আর এভাবেই পুরোদস্তুর এক প্রশ্নবালিকা বনে গিয়েছিলেন কিশোরী আমিনা। বলা বাহুল্য, প্রশ্ন করার অভ্যাসই একদিন তাকে স্বদেশভূমি থেকে ইংরেজদের দেশে ‘নির্বাসিত’ করেছিল। সেই স্বেচ্ছা নির্বাসন ছিল জ্ঞানের জন্য, জীবনসংসারের গূঢ় রহস্য উন্মোচন করার জন্য।

উচ্চশিক্ষার বিষয় হিসেবে আমিনা বেছে নিয়েছিলেন রসায়নকে। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব সারে থেকে ১৯৮৩ সালে তিনি রসায়নে স্নাতক সম্পন্ন করেন। আর ১৯৮৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার থেকে জৈব রসায়নে পিএইচডি।

শৈশবের বিজ্ঞানবোধ

দ্বীপদেশ, কিংবা আমিনার ভাষায়, ‘জীববৈচিত্র্যের স্বর্গভূমি’ মরিসাস ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার আগেই জীবনের ব্রত স্থির করেছিলেন আমিনা।

তার শৈশবস্বপ্ন নিয়ে এক আলোচনায় ফ্রান্সের পিয়েরে এ্যান্ড মেরি কুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউপিএমসি) ভাইস প্রেসিডেন্ট (শিক্ষা) ফেব্রিক কেমলা বলেছেন, ‘১৯৭৮ সালে প্রথম টেস্টটিউব বেবি লুইস ব্রাউনের জন্ম হয়েছিল। সে সময় আমিনা (তখন তার বয়স উনিশ) উপলব্ধি করেছিলেন, ‘বিজ্ঞান সত্যি সত্যি জীবন বদলে দিতে পারে।’

উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর আমিনার এই উপলব্ধি বাস্তব একটা ভিত পেয়েছিল। তিনি অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দেশমাতৃকার উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নেন।

ইউপিএমসিকে দেওয়া এক সম্ভাষণে আমিনা গারিব-ফাকিম সেই ‘মধুর মুহূর্ত’ সম্পর্কে বলেছেন, ‘পিএইচডির পর যুক্তরাষ্ট্রে পোস্টডক করার সব হিসেবনিকেশ তৈরি ছিল। কিন্তু তার বদলে আমি মরিসাসে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিই।’

আমিনা বলেন, ‘সাংশ্লেষিক জৈব রসায়ন নিয়ে আমার যত গবেষণা যত প্রশিক্ষণ, সবকিছু সেখানে আমি সম্পূর্ণ নতুন এক জ্ঞানশাস্ত্রে প্রয়োগ করি। বলছি, ফাইটোকেমিস্ট্রির কথা।’

ফাইটোকেমিস্ট্রি হলো উদ্ভিদ ও উদ্ভিজ্জ উপাদান নিয়ে এক বিশেষ রসায়নশাস্ত্র। এখানে উদ্ভিদ থেকে তার প্রাকৃতিক উপাদানগুলো সংশ্লেষ করা হয়।

মরিসাসে প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে আমিনা বলেন, ‘আমার এই অভিবাসন খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কেননা বিশ্বের অন্যতম অসাধারণ জীববৈচিত্র্য হটস্পটে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমি খুব উর্বরই হব।’

বৈজ্ঞানিক ব্যবসায়িক

দেশে ফেরার পর সেই কথা প্রমাণ করেছেন আমিনা। ১৯৯৪ সালে তার নেতৃত্বেই মরিসাসে প্রথম সুগন্ধী ও ঔষধী উদ্ভিদের একটা তালিকা তৈরি হয়।

সে সময় মরিসাসে ৬৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ ছিল। এদের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ উদ্ভিদ ছিল স্থানীয় বা স্বদেশী। এই কাজটা সহজ ছিল না মোটেও। উদ্ভিদরাজি ও এদের গুণাগুণ উদ্ধার করতে স্থানীয়দের দরবারও করেছেন আমিনা। তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতেন। আর গবেষণাগারে সেসব তথ্য যাচাই করতেন। এভাবেই আমিনা আফ্রিকার ঔষধী উদ্ভিদকে পণ্যজাত দিলেন।

এ সম্পর্কে আমিনা বলেছেন, ‘আমি জানি, গবেষণা ও উন্নয়নের যুগপৎই একটা দেশের উন্নতির ইঞ্জিন। এ জন্য আমি আমার গবেষণা-জ্ঞানকে ব্যবসায়িক রূপ দিতে চেয়েছিলাম। এটা আমাকে একজন বৈজ্ঞানিক ব্যবসায়িক হিসেবে তৈরি করেছিল।’

তার গবেষণা আমিনাকে অন্তত ২০টি বই লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখেছেন আশিখানার মতো। তার সম্পাদনায় ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে আফ্রিকার প্রথম ফার্মাকোপিয়া।

স্বীকৃতি ও সম্মাননা

দেশী-বিদেশী বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বিজ্ঞানী আমিনা। ২০০৭ সালে এল’ওরিয়াল-ইউনেস্কো উইমেন অব ইন সায়েন্স নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৯ সালে আফ্রিকান ইউনিয়নের অন্যতম ‘উইমেন ইন সায়েন্স’ নির্বাচিত হন। একই বছর ‘নাইট অব দ্য অর্ডার অব এ্যাকাডেমিক পামস’ পদবীতে সম্মানিত হন আমিনা। ইউনিভার্সিটি অব পিয়েরে এ্যান্ড মেরি কুরি তাকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।

আমিনা ২০০৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অব মরিসাসের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

জীবনে এমন সফল হওয়ার গোপন কোনো রহস্য আছে নাকি কোনো? আমিনাকে জানতে চাইলে তিনি বলবেন, ‘নিজের সর্বোচ্চটা ঢেলে দাও। আর যা করছ তা আনন্দ নিয়ে করো।’

আনন্দের সঙ্গে কাজ করলে ক্লান্তি আসে না জীবনে। আমিনা যেমনটা বলেছেন, ‘তুমি যদি ভীষণ উচ্ছ্বাস-উৎসাহ নিয়ে কাজ করো, দেখবে জীবনে যেন একটা দিনও তুমি কোনো কাজই করোনি। যেমনটা মনে হয় আমারও!’

‘আরেকটা মক্কা’ যার প্যারিসে

ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্তিত ন্যাশনাল ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়ামকে নিজের ‘মক্কা’ মানেন আমিনা। তার ভাষায়, ‘আমি যতবারই প্যারিসে যাই, ততবারই সেখানে ঘুরতে যাই। এটা আমার কাছে যেন আরেক মক্কা’।

প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট

মরিসাসের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৫ জুন শপথ নিচ্ছেন আমিনা। তিনি দেশটির ৬ষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শুক্রবার অধিষ্ঠ হচ্ছেন।

মরিসাসের সংসদ বৃহস্পতিবার আমিনাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করে। দেশটির সরকারি ও বিরোধী দল উভয়ই তাকে এক বাক্যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিয়েছেন। এটাকে ‘ঐতিহাসিক পরিবর্তন’ হিসেবে দেখছে মরিসাসের রাজনীতিকরা।

প্রসঙ্গত, আমিনার জন্ম ১৯৫৯ সালের ১৭ অক্টোবর, মরিসাসের সুরিনামে।

একদিন বাংলাদেশেও…

শুধু মরিসাসে নয়, উন্নত অনেক দেশে ক্ষমতার প্রধান পদগুলোতে বিজ্ঞানীদের অধিষ্ঠ হতে দেখা যাচ্ছে । যেমন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ থেকে চিলির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেনমিচেল ব্যাচেলেট। জার্মানির প্রথম নারী চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মার্কেল ছিলেন কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রির গবেষক।

এরকম পদে বিজ্ঞানীরা অভিষিক্ত হলে দেশের কি কোনো বাড়তি সুবিধে হয়? জানতে চেয়েছিলাম বিজ্ঞানী বিধান চন্দ্র দাসের কাছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই। দেশের উন্নয়নে নীতি-নির্ধারণে বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ থাকাটা খুব জরুরি।’

বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা কি এই স্বপ্ন দেখতে পারেন যে, সর্বোচ্চ ক্ষমতায় একদিন দেশের বিজ্ঞানীরাও আসীন হবেন?

ড. বিধান বলেন, ‘দেখুন, বঙ্গবন্ধুর সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিজ্ঞানীদের কিন্তু বড় একটা প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে ড. কুদরত-ই-খুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোস অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী প্রমুখের কথা।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক বিধান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু তার জামাতা হিসেবে খুঁজে পেয়েছিলেন একজন বড় মাপের পরমাণু বিজ্ঞানীকে।’

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের পর কি চিত্রটা বদলে যায়নি, বিজ্ঞানীরা কি সেভাবে আর নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে বিশেষ ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছেন? প্রশ্ন করি বিজ্ঞানীকে।

প্রাণীবিজ্ঞানী বিধান বলেন, ‘এটা ঠিক যে হারটা কমেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে আমরা বিজ্ঞানী-প্রকৌশলী-স্থপতিদের ক্ষমতায় আসতে দেখেছি। যদিও মরিসাসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আজ (৫ জুন) যিনি শপথ নিচ্ছেন, সেই আমিনার মাপের বড় বিজ্ঞানী আমাদের দেশে কজনইবা আছেন।’

তবে ড. বিধানচন্দ্র দাস আশাবাদী, সময়ই ফের চিত্রটা বদলে দেবে। এই বিজ্ঞানী বলেন, ‘বিজ্ঞানীদের দরকার পড়বেই। দেশের কল্যাণেই একদিন রাষ্ট্রযন্ত্র বিজ্ঞানীদের উচ্চাসনে অধিষ্ঠ করবে।’

সময়ই তবে যা বলার বলুক।

তথ্যঋণ : ইউপিএমসি।